স্টাফ রিপোর্টারমিজানুর রহমানঃ
বাংলাকে একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র গঠনের বঙ্গবন্ধু যখন ডাক দিয়েছিলেন,তখন বাংলাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কৃষক শ্রমিক বাংলার দামাল ছেলেরা। তখন বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানা দুর্গানগর ইউনিয়ন ভাটবেড়া গ্রামের সহোদর চার ভাই যুদ্ধ জয়ের পরিকল্পনা ছক আঁকেন। তখন দেশ মাতৃকাটানে তিন ভাই আবু বক্কর,আব্দুস সাত্তার, আখতারুজ্জামান পায়ে হেটে ওপার যাওয়ার চিন্তা-ভাবনায় বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।প্রথম যাত্রায় তারা সুবিধা করতে না পেরে পুনরায় বাড়িতে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে আবু বক্কর গোপনে বাড়ি থেকে একাই বের হয়ে যান।
এরপর তার ছোট দুই ভাই আব্দুল সাত্তার ও আখতারুজ্জামান দুই ভাই ভারতের উদ্দেশ্যে পুনরায় রওনা দেন, এবারের যাত্রাটা তাদের জন্য সহজ ছিল না। অনেক খাল নদী সাঁতরিয়ে পার হবার সময় মৃত পশু পাখি গরু,মহিষ , মানুষ ডিঙিয়ে পার হতে হয়েছে। মর্মান্ত এক দৃশ্য,বাংলার ওপার গিয়ে দেখা হয়ে যায় তাদের গ্রামের হিন্দু এক মুভির সাথে। তিনি তাদের দুই ভাইকে বাংলায় ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে, কিন্তু তাদের লক্ষ্যে অনর থেকে ভারতের বাহাদুরাবাদ ঘাট দিয়ে রৌমারীতে ট্রেনিং করে। ওখান থেকে তুরা ট্রেনিং করে, হায়ার ট্রেনিং এর জন্য ভারতের কুচবিহার যান । টেলিং প্রাপ্ত হয়ে ভারতের মেঘালয় ডালো ক্যাম্পে অবস্থান করে। সেখানে সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালি উপজেলা হাসকাউনিয়া ইউনিয়নে গ্রাম কুড়কি পিতা মৃত ওসমান শিকদারের ছেলে আবু ইউসুফ হাক্কানীর যুদ্ধ প্রশিক্ষণ কমান্ডারের কাছে যুদ্ধের বিভিন্ন কলা কৌশল লপ্ত করেন।ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকালে উল্লাপাড়ার উপজেলার দহকুলা গ্রামের আজিজুল মাস্টার, তাইজেল মাস্টার,মাজেদ,সোহরাব,কাশেম আরো কয়েকজনের সাথে দেখা হয়।
কোনাবাড়ি গ্রামের নাসির, ডুবডাঙ্গা গ্রামের সাকাওয়াত, সহ অনেকের সাথেই সাক্ষাৎ হয় একসাথে তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এরপর আব্দুল সাত্তার ও আকতারুজ্জান ট্রেনিং শেষ করে অস্ত্র নিয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট সংলগ্ন মাইনকারচর স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন। কিছুদিন পর ওইখান থেকে জামালপুর এসে কমান্ডার নামদার ও সিরাজ সাহেবের আন্ডারে যুদ্ধে অংশ নেন।ওইখান থেকে বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা চৌখালী বেলকুচি হয়ে কুটনি দৌলতপুর বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।খোকনিতে কমেন্টার ছিলেন হেমন্ত বাড়ির রতন পিতা ভোলা সরকার। যুদ্ধ বিজয়ের কিছুদিন আগে তারা সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়া খোরশেদ কমান্ডারে, প্লাটুন কমান্ডার সামাদ গ্রাম বাখুয়া সাথে মিলিত হন।
এর মাঝে তাদের আরেক বড় ভাই শাজাহান পুলিশ পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের কমেন্ডার খোরশেদ আলম সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।খোরশেদ আলম ভারত থেকে অস্ত্র গোলা বারুদ আনার জন্য যখন রওনা হয়, শাজাহান পুলিশকে চার নম্বর নৌকার কমান্ডার দায়িত্ব দিয়ে জান। সেই শাজাহান পুলিশ ও স্বাধীনতা এত বছর পরও কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করা একজন মুক্তিযোদ্ধা তার নাম মুক্তিযুদ্ধায় তালিকায় তুলতে পারেননি। দেশ স্বাধীন এর পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে পুলিশের চাকরিতে ফিরে যান আখতারুজ্জামান পুলিশের চাকরি পান। আব্দুস সাত্তার ঢাকায় চলে যান। দীর্ঘ সময়ের ভিতরে তাদের কাছে থাকা মুক্তিযোদ্ধা দলিলগুলো বাড়িতে রাখা টাং সহ গায়েব হয়ে যায়।
এর মাঝে তাদের বড় ভাই আবু বক্কর এর নাম মুক্তিযুদ্ধ তালিকা সংরক্ষিত হয়েছে। আব্দুস সাত্তার ও আখতারুজ্জামান, শাজাহান পরামানিকের কাছে জানা যায় ৯৬ সালের আগেও তারা মুক্তিযোদ্ধা অফিসে তাদের নাম দেখতে পেয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভাতা শুরু হলে পরবর্তীতে তাদের নামগুলি তালিকা পায়না। যার ফলে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময সরকার ঘোষণা করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করা হবে। তখনই তাদের সহপাঠী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্বাসে তারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তোলার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে যাচাই-বাছাই কালে যাদেরকে সাক্ষী বানানো হয়েছিল, ঐদিন উল্লাপাড়া উপজেলা চত্বরে সাক্ষী মঞ্চে উপস্থিত হয়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী কিছু সুবিধাবাদী দুষ্টচক্র কিছু মুক্তিযোদ্ধা ঐ সকল সাক্ষীদের ভয় ভীতি দেখায়।তোমরা যদি মুক্তিযোদ্ধা সাক্ষী দাও, তবে তোমাদের ভাতা স্থগিত করে দিবে সরকার।এই ধরনের ভয়-ভীতি দেখিয়ে মানসিক টর্চার করলে সাক্ষী ডাকার আগ মুহূর্তে আব্দুস সাত্তার ও ছোট ভাই আখতারুজ্জামানের সাক্ষী হল রুম থেকে সরে যান। কিন্তু তাদের আরেক বড় ভাই শাজাহান এর পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির উপজেলা কমান্ডার খোরশেদ আলম, রফিকুল ইসলাম,গোপাল চন্দ্র সরকার এই তিনজন মুক্তিযোদ্ধা সাক্ষী দেওয়ার পরও তার নাম (ক) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। যেখানে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য এবং তখনকার কমেন্টার, এবং যুদ্ধকালীন সময়ের কমান্ডার ছিলেন, সেই খোরশেদ আলম নিজে সাক্ষী হয়ে বলেছেন আমি তাকে চার নম্বর নৌকার কমান্ডার বানিয়ে ভারতে লতি মির্জার অনুরোধে অস্ত্র আনতে যাই। আমি ভারতে থাকা অবস্থায় তিনি শাহজাহান পুলিশ দায়িত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এত বড় একটি সাক্ষীর দেবার পরও শাজাহান পুলিশের নাম(ক) তালিকায় উড়তে ব্যর্থ হয়।কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে সেই তালিকা কিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম (ক) তালিকা অন্তর্ভুক্ত করেছে, যাদের কে তার গ্রামের মুরুব্বী থেকে শুরু করে যুবক কেউ জানে না এমন কি আজ অব্দিও বলতে পারে না যুদ্ধের টেলিং কিভাবে যুদ্ধ অংশগ্রহণ করেছিল এমন কোন প্রশ্ন কারো জানা এবং সোনা নাই। সেই ব্যক্তিও মুক্তিযোদ্ধার (ক) তালিকা নাম উঠে গেছে।জানা যায় ওই ব্যক্তির ভাই এবং সন্তানেরা সরকারি চাকরি করা প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
এই ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, কেন সাক্ষীগণ, সাক্ষী না দিয়ে চলে আসলেন।
এ ব্যাপারে আব্দুস সাত্তার ও আখতারুজ্জামান এর সন্তানেরা সাক্ষী দহকুলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল মাস্টার কোনাবাড়ী অ্যালোংজানি মুক্তিযোদ্ধা নাসির বলেন, আমাদের কে ভয়-ভীতি ও মানসিক ভাবের হেনস্থা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে আরো গভীর অনুসন্ধানে গেলে মোহনপুর ইউনিয়নের একজন মুক্তির যোদ্ধার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, তোমার বাপ চাচারা সত্যিকারি অর্থেই একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন যারা ভারতে ট্রেনিং প্রাপ্ত। কিন্তু তারা প্রথমে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এর অঞ্চলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের শেষ ভাগে এসে আমাদের সাথে যোগ দেয় যার ফলে এই এলাকার অনেকেই তাদেরকে চেনেন না। কিন্তু তোমার বড় চাচা আবু বককরকে সবাই চিনেন। এবং আমরা সবাই তার ধরতে গেলে শীর্ষ । তিনি আরো বলেন যত কথাই বলি আজকাল চ্যানেল ছাড়া কোন কাজ হয় না। এই দেখনা রাউতানের আফসার ছেলে আনসার জীবনে কখনো মুক্তিযোদ্ধার কাছেও যায়নি।
সে আমাদের চ্যানেলের ছিল, যার কারণে সবাই মিলে তাকে পার করে দিলাম।
আজকাল চ্যানেল ছাড়া কোন কিছুই করা সম্ভব না, এ যুগের ছেলে বাপু তোমরা সবই বুঝ।ওই সময় চ্যানেলের চাহিদা সাত্তার, আখতারুজ্জামানের সন্তানের কাছে অসম্ভব ছিল। যার ফলে খালি হাতেই ফিরতে হয় তাদের।
যাচাই বাছাই শেষ প্রান্তে এসে কাকতালীয়ভাবে উল্লাপাড়া উপজেলা চত্বরে দেখা হয়ে যায় ৪৫,৪৬ বছরের আগের ভারতের ডালো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের চৌহালী আবু ইউসুফ হক্কানী ওস্তাদের সাথে। দীর্ঘদিন পরে তার প্রাণপ্রিয় ছাত্রদের পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এবং সাথে সাথে তিনি যাচাই-বাছার কমিটির সভাপতি সাবেক এমপি গাজী শফিকুল ইসলাম শফিকের কাছে ফোন করেন। কিন্তু শফি সাহেব আফসোস করে বলেন ভাই আজকেই ফাইল বন্দি করা হয়ে গেছে। আপনি আপিলের ব্যবস্থা করেন।
সেই থেকেই আপিলেই ঝুলছে এ সকল হতভাগা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যলিপি।
স্বাধীনতা এত বছর পরে এসে ওই জাতি দিতে পারল না প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা।
আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা গ্রাম ছাড়া।
চলমান
Leave a Reply